প্রতিটি প্রাণীই জন্মের প্রথম মুহূর্ত থেকেই তার চারপাশের পরিবেশকে দেখে, স্পর্শ করে, ও বুঝে নেয়। এভাবেই আমাদের সকলের মাথার ভেতরে পরিচিত একটি জগতের মানচিত্র তৈরি হয়ে ওঠে। যখন একটি শিশু প্রথম কোনো প্রাণী দেখে, সে শুধু একটি আকৃতি দেখে না সে শেখে “এটাই সেই প্রাণী”, এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় তার গন্ধ, রং, ও চলার ধরণও। এরপর থেকে তাকে দেখলেই আমাদের মস্তিষ্ক তৎক্ষণাৎ চিনে নেয়।
এভাবেই অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির স্তরে স্তরে আমাদের পরিচিত জগৎ গড়ে ওঠে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মানচিত্র তৈরি হতেই থাকে, প্রতিটি নতুন মুখ, নতুন ঘটনা আমাদের ভেতরের লাইব্রেরিতে যোগ হয়।
ধরুন আপনি একদিন এমন কিছুর সামনে দাঁড়ালেন যা আপনি আগে কখনোই দেখেননি, শোনেননি, এমনকি স্বপ্নেও ভাবেননি। আপনার চোখের সামনে বস্তুটি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ফাঁকা, কোনো পরিচিতির ইঙ্গিত নেই। আপনার ব্রেইন তার পুরোনো অ্যালবামে খুঁজে দেখে, কিন্তু কোনো মিল পায় না। তখন কি আপনি বলবেন: “এটা নেই, কারণ আমি চিনি না?” নাকি নতুন করে সে বস্তুটির তথ্য বা স্মৃতি সংরক্ষণ করবেন এবং নতুন একটি বাস্তবতা মেনে নেবেন?
মহাবিশ্বের 'বিগ ব্যাং' ( Big Bang ) এর আগের মুহূর্তটি ঠিক এইরকমই এক অচেনা এলাকা। আমরা তাকে কল্পনা করতে পারি না, ব্যাখ্যা করতে পারি না, কারণ আমাদের অভিজ্ঞতার প্রতিটি উদাহরণ পাহাড়, আলো, শব্দ, সময়—সবকিছুই এসেছে বিগ ব্যাং-এর পরের পৃথিবী থেকে। তাই বিগ ব্যাং-এর আগের বাস্তবতা আমাদের পরিচিত মস্তিষ্কের ডাটাবেসে নেই। সেই অদৃশ্য জগৎ যেন এক বন্ধ দরজা, যার ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু আছে—কিন্তু আমরা জানি না তার নাম কী, রঙ কী, বা আকার কী। আমরা তখন প্রশ্ন করি: আগেরটা কি শূন্য ছিল?
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে শূন্যতাকে বুঝি, তার মানে হলো—ফাঁকা ঘর, নিস্তব্ধতা, বা কোনো কিছুর অনুপস্থিতি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্বের জন্মের আগের 'শূন্যতা' একেবারেই ভিন্ন ছিল। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুসারে, সেই শূন্যতাও শূন্য ছিল না!
সেখানে ছিল চরম অস্থিরতা, অফুরন্ত শক্তির টগবগে উথাল-পাথাল। এমন এক অবস্থা, যেখানে আমাদের ভাষা, আমাদের কল্পনা, আমাদের বিজ্ঞান সবই হঠাৎ থেমে যায়। কারণ আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় ঐ ধরনের শূন্যতার কোনো উদাহরণ নেই। আমরা যাকে ফাঁকা বলে ভাবি, কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে ওখানেই ছিল সবকিছুর বীজ। সেখানে ছিল pure energy-এর ঘূর্ণি, ক্ষুদ্রতম কম্পনের ঢেউ, যেখানে স্থান (Space) বা সময় (Time) বলেও কিছু ছিল না, কিন্তু ছিল সৃষ্টির অনন্ত সম্ভাবনা। এই অচেনা জগৎ থেকেই জন্ম নিয়েছে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব।
সুতরাং প্রশ্নটা খুবই গভীর, যা আমরা কল্পনা করতে পারি না, তা কি নেই? নাকি আমাদের কল্পনা এখনো সেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত নয়?
বিজ্ঞান ধীরে ধীরে সেই রহস্যের দরজার কাছে পৌঁছাচ্ছে। নতুন স্মৃতি, নতুন মডেল, নতুন ধারণা যোগ হচ্ছে মানব মস্তিষ্কের লাইব্রেরিতে। হয়তো একদিন আমরা বলতে পারব "হ্যাঁ, বিগ ব্যাং-এর আগের জগৎকে আমরা দেখি, বুঝি, ও চিনি।"
কিন্তু আজকের দিনে আমাদের কাছে সেটি এক রহস্যময় অচেনা অঞ্চল, যেখানে শূন্যতা ফাঁকা নয়, বরং তা পরিপূর্ণ শক্তি, সম্ভাবনা, আর সৃষ্টির উষ্ণ আগুনে। সেই “অচেনা” থেকেই জন্ম নিয়েছে “চেনা” আমরা, তারা, সময়, স্থান, সবকিছু। তাই যা আমরা এখনো কল্পনা করতে পারি না তাও অনেক সময় সত্যিই থাকে, কেবল আমাদের পরিচয়ের অপেক্ষায়।
এখানে ব্যক্তিগত চিন্তার প্রতিফলন আছে, আমি শুধুমাত্র আমাদের সীমাবদ্ধতার একটি দৃশ্য আপনাদের সামনে আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। যেটা অসম্পূর্ণ মনে হতে পারে, যদি তাই হয় তবে আপনিও যোগ করতে পারেন। এতে সমৃদ্ধ হবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়।
- আল মামুন রিটন
Tags
রহস্য
