(কল্পিত দৃশ্য, জেনারেটেড)
(আল মামুন রিটন, বিজ্ঞান তথ্য): আমরা মহাবিশ্বে যে সব কিছু দেখি যেমন উজ্জ্বল তারা, ঘূর্ণায়মান গ্যালাক্সি, বা আমাদের নিজেদের পৃথিবী এগুলো সবই সাধারণ পদার্থ (Normal Matter) বা ব্যারিয়নিক পদার্থ (Baryonic Matter) দিয়ে তৈরি। এই সাধারণ পদার্থই হলো সেই অ্যাটম ভিত্তিক উপাদান যা বিগ ব্যাং-এর পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মহাবিশ্বের এক বিস্ময়কর সত্য হলো: আমাদের দেখা এই দৃশ্যমান পদার্থ মহাবিশ্বের মোট সাধারণ পদার্থের মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব এবং কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) বিকিরণের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মহাবিশ্বে যত সংখ্যক সাধারণ পদার্থ থাকা উচিত, তার প্রায় ৯০ শতাংশেরও বেশি অদৃশ্য বা 'হারিয়ে' গিয়েছিল বলে মনে করা হতো।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেন, কোটি কোটি গ্যালাক্সিতে যে সকল তারা জ্বলছে, তারা মহাবিশ্বের মোট সাধারণ পদার্থের মাত্র প্রায় ১০ শতাংশ ধারণ করে। বাকি ৯০% সাধারণ পদার্থ কোথায়? এটি হলো সেই রহস্য, যা বহু দশক ধরে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলী করে তুলেছিল।
সাম্প্রতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলি দেখিয়েছে যে এই হারিয়ে যাওয়া পদার্থগুলো আসলে কোনো শূন্যস্থানে হারিয়ে যায়নি, বরং তারা লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের সুবিশাল, অদৃশ্য এক কাঠামোর মধ্যে, যাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন কসমিক ওয়েব বা মহাজাগতিক জাল।
এই কসমিক ওয়েব হলো মহাবিশ্বের বৃহত্তম কাঠামো, যা তৈরি হয়েছে তিনটি প্রধান উপাদান দিয়ে:
১| ফিলামেন্ট (Filaments): এগুলি হলো সুতো বা তন্তুর মতো বিশাল রেখা, যা শত কোটি আলোকবর্ষজুড়ে বিস্তৃত।
২| ক্ল্যাস্টার (Clusters): ফিলামেন্টগুলো যেখানে মিলিত হয়, সেখানে গ্যালাক্সির ঘনত্ব অনেক বেশি থাকে।
৩| ভয়েড (Voids): ফিলামেন্ট এবং ক্ল্যাস্টারের মধ্যবর্তী প্রায় খালি অঞ্চল।
এই কসমিক ওয়েবের ফিলামেন্টগুলোই হলো সেই লুকানো ভান্ডার। এর ভেতরে থাকা উত্তপ্ত গ্যাসকে বলা হয় ইন্টারগ্যালাক্টিক মিডিয়াম (Intergalactic Medium) বা IGM।
এই IGM গ্যাসটি এত উত্তপ্ত যে এর তাপমাত্রা প্রায় মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়। এই উচ্চ তাপমাত্রার কারণে অ্যাটমগুলো তাদের ইলেকট্রন হারিয়ে ফেলে আয়নিত প্লাজমা অবস্থায় থাকে অর্থাৎ, প্রোটন ও ইলেকট্রনগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ছোটাছুটি করে।
সাধারণ গ্যাস শীতল হলে দৃশ্যমান আলো (যেমন, নীহারিকা) বা রেডিও তরঙ্গে ধরা পড়ে। কিন্তু IGM এতটাই উত্তপ্ত এবং এত বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকে যে, এটি দৃশ্যমান বা রেডিও টেলিস্কোপে সহজে ধরা পড়ে না। এর আলো মূলত অতি ক্ষীণ এক্স-রে এবং অতি-বেগুনি (UV) বিকিরণ হিসেবে নির্গত হয়।
এই উত্তপ্ত IGM-ই হলো সেই হারিয়ে যাওয়া ৯০% সাধারণ পদার্থের সিংহভাগ। গ্যালাক্সিগুলো এই কসমিক ওয়েবের ফিলামেন্টগুলির সংযোগস্থলে উজ্জ্বল মুক্তার মতো বসে আছে, আর ফিলামেন্টের অদৃশ্য শিরা-ধমনীতে বইছে এই উত্তপ্ত গ্যাস।
দীর্ঘদিন পর এই মিসিং ম্যাটার সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে শক্তিশালী এক্স-রে টেলিস্কোপ এবং অতি-বেগুনি স্পেক্ট্রোস্কোপের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত দূরবর্তী ও উজ্জ্বল কোয়াসার (Quasar) থেকে আসা আলোর স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করে দেখেন যে, এই আলো যখন কোটি কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে আমাদের কাছে আসে, তখন পথে থাকা উত্তপ্ত IGM গ্যাস দ্বারা শোষিত হয়।
এই শোষণের ফলে আলোর স্পেকট্রামে কিছু নির্দিষ্ট 'ভাঙা রেখা' তৈরি হয়, যা প্রমাণ করে যে অদৃশ্য IGM-এ বিশাল পরিমাণে উত্তপ্ত, আয়নিত গ্যাস বিদ্যমান।
মহাবিশ্বকে আমরা যেভাবে দেখি (তারা, নীহারিকা), তা হলো কেবল তার উজ্জ্বল এবং ঘন অংশ। কিন্তু এর প্রকৃত ভর, উপাদান এবং কাঠামো লুকিয়ে আছে গ্যালাক্সিগুলোর মাঝের আপাত-শূন্যস্থানে, সেই উত্তপ্ত, নীরব ও বিশাল কসমিক ওয়েবের ফিলামেন্টগুলির IGM-এ।
সূত্র: আর্থ, Xoivis
