-->

অনিশ্চয়তার মধ্যেই বোধের দীপ্তি

ছবি ক্রেডিট: পিক্সেল

মানুষের জীবন আসলে এক বৈচিত্র্যময় ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ধারাবাহিক কাব্য, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত যেন একেকটি নতুন ছন্দ, নতুন রঙ, নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। জন্মের পর থেকেই আমরা এক অবিরাম যাত্রায় পা রাখি—যে যাত্রার কোনো পূর্বনির্ধারিত মানচিত্র নেই, নেই নিশ্চয়তা, নেই স্থায়িত্ব। তবু এই অনিশ্চিত পথেই লুকিয়ে থাকে জীবনের আসল সৌন্দর্য, কারণ নিশ্চিততার মধ্যে কখনোই বোধ জন্মায় না, বোধ জন্মায় অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে, অজানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আসলে এক একটি প্রশ্নচিহ্ন, আর মানুষ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই নিজেকে আবিষ্কার করে।

আমরা প্রায়ই ভাবি জীবন মানে সুখের সন্ধান, অথচ সত্য হলো—জীবনের গভীরতম উপলব্ধি জন্ম নেয় বেদনার মধ্যেই। আনন্দ আমাদের মুহূর্তিক উচ্ছ্বাস দেয়, কিন্তু বেদনা আমাদের শেখায়; শেখায় সহনশীলতা, উপলব্ধি, এবং আত্মবিকাশের অর্থ। যে মানুষ কষ্টের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, সে জানে ভালোবাসার মূল্য, জানে শান্তির গভীরতা। জীবনের এই পরস্পরবিরোধী দ্বৈততা—আনন্দ ও বেদনার মিশ্রণই একে করে তোলে পূর্ণাঙ্গ। একে বাদ দিলে জীবন কেবল যান্ত্রিক অস্তিত্বে পরিণত হতো, যেখানে আত্মার কোনো বিকাশ হতো না, শুধু বেঁচে থাকা হতো।

অনেকেই মনে করেন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো জীবনের বাধা। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো—এই ঘটনাগুলোই মানুষকে গড়ে তোলে। যেভাবে উত্তপ্ত আগুনে সোনা বিশুদ্ধ হয়, ঠিক সেভাবেই বিপর্যয় মানুষের ভেতরের অমেধ্য পুড়িয়ে ফেলে, তাকে নতুনভাবে চিনতে শেখায়। অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা, ব্যর্থতা, হারিয়ে ফেলা—সবই জীবনের শিক্ষার অংশ। মানুষ যতবার পড়ে, ততবারই সে শিখে দাঁড়াতে। প্রতিটি আঘাতই তাকে শেখায় কীভাবে বাঁচতে হয়, কীভাবে না হার মানতে হয়। আর এই সংগ্রামের মধ্যেই জন্ম নেয় বোধ—যে বোধ মানুষকে কেবল জীবিত রাখে না, বরং জীবনের গভীর অর্থ বোঝাতে শেখায়।

জীবন একধরনের অবিরাম রূপান্তরের প্রক্রিয়া, যেখানে পরিবর্তনই একমাত্র স্থায়ী সত্য। একদিন যে মানুষ হাসে, পরদিন সে কাঁদে; একদিন যে স্বপ্ন দেখে, অন্যদিন সে হারায়। কিন্তু এই হারানো-জেতার ভেতর দিয়েই মানুষ উপলব্ধি করে অস্তিত্বের অমূল্যতা। আমরা যদি সবকিছু আগেই জানতাম, যদি সব কিছু আমাদের মতোই ঘটত, তাহলে জীবনের মানে হারিয়ে যেত। অনিশ্চয়তা, অজানা, আর প্রতিনিয়ত নতুন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। তাই বলা যায়, জীবনের প্রকৃত সারমর্ম লুকিয়ে আছে এর অপ্রত্যাশিততায়, এর বৈচিত্র্যের ভেতরেই।

অবশেষে বলা যায়, জীবন কোনো নিখুঁত গাণিতিক সমীকরণ নয়, যেখানে প্রতিটি উত্তরের হিসাব মেলে। বরং এটি এক কবিতা, যার প্রতিটি পংক্তি অনিশ্চিত, কিন্তু অর্থবহ; এক সুর, যার প্রতিটি তান নতুন অভিজ্ঞতার দিকে নিয়ে যায়। আমরা কখনও ভুল করব, কখনও ভাঙব, আবার গড়ব, কিন্তু প্রতিবারই একটু বেশি জানব, একটু বেশি বুঝব, আর একটু বেশি মানুষ হয়ে উঠব। জীবন তাই শুধুই সময়ের প্রবাহ নয়—এ এক চলমান বোধের জাগরণ, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই শেখার, অনুভবের, আর বাঁচার আহ্বান।

এই বোধটাই আমাদের মানবিকতার শিকড়, যা শেখায়—সবকিছু নিখুঁত না হলেও জীবন সুন্দর। কারণ, জীবনের অনিশ্চয়তাই তার কবিতা, তার রহস্য, আর তার অসীম সম্ভাবনা।