-->

ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানের গোপন রহস্য

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম বড় পরীক্ষা আসে ২০০০ সালে কুর্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয়ে। সরকারের ধীর প্রতিক্রিয়া প্রাথমিকভাবে দুর্বলতা প্রকাশ করলেও, পুতিন


বিশ্ব ইতিহাসে এমন কিছু উত্থান আছে যা কেবল রাজনীতির পটপরিবর্তন নয়, বরং একটি যুগের শুরু। ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণ তেমনই এক বিস্ময়কর আখ্যান। ১৯৯৯ সালে যখন তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তিনি ছিলেন প্রায় অচেনা এক মুখ। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভয়াবহ অ্যাপার্টমেন্ট বোমা হামলা এবং গণ-ভীতির পটভূমিতে, একজন প্রাক্তন কেজিবি এজেন্ট খুব দ্রুতই বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠেন। কিন্তু ঠিক কী ছিল এই অপ্রত্যাশিত উত্থানের নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন রহস্য? চলুন, আমরা সেই পথ ধরে হেঁটে দেখি।

কেজিবির ছায়া এবং ক্ষমতার ভাঙ্গন

পুতিনের বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হলে আমাদের তাঁর তরুণ বয়সে ফিরে যেতে হবে—সেন্ট পিটার্সবার্গে তাঁর আইন পড়া এবং সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবিতে যোগ দেওয়া। পূর্ব জার্মানিতে কেজিবি এজেন্ট হিসেবে কাজ করার সময় তিনি দেখেছেন বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং শীতল যুদ্ধের করুণ সমাপ্তি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই ভাঙ্গন তাঁর চোখে কেবল একটি দেশের পতন ছিল না, ছিল ক্ষমতার এক ভয়াবহ শূন্যতা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর মনে পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাবের বীজ বপন হয়, যা পরে একটি শক্তিশালী, কেন্দ্রীয় রাশিয়ার ধারণাকে তাঁর চেতনার মূল চালিকাশক্তি করে তোলে।

ক্ষমতার পথ: বিশৃঙ্খলা ও কঠোরতা

কেজিবি-র পতনের পর, পুতিন সেন্ট পিটার্সবার্গে কাজ শুরু করেন। সেই সময়ে নব্বইয়ের দশকের রাশিয়ার নৈরাজ্য, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সংগঠিত অপরাধের বাড়বাড়ন্ত তাঁকে একটি শক্তিশালী শাসনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত করে তোলে।

মস্কোতে তাঁর কর্মজীবন এরপর রকেটের গতিতে এগিয়ে চলে। কিন্তু তাঁর উত্থানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক ছিল ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের সিরিজ অ্যাপার্টমেন্ট বোমা হামলা। সরকার দ্রুত এই হামলার জন্য চেচেন সন্ত্রাসীদের দায়ী করে। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুতিন অত্যন্ত কঠোর হাতে এই হামলার প্রতিক্রিয়া জানান এবং চেচনিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু করেন। এই কঠোরতাই ছিল সেই সময়ে রাশিয়ার আতঙ্কিত জনগণের আকাঙ্ক্ষিত নেতৃত্ব, যা তাঁকে দ্রুত জনসমর্থনের শীর্ষে নিয়ে আসে এবং বরিস ইয়েলৎসিনের উত্তরাধিকারী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হতে সাহায্য করে। ক্ষমতার জন্য তাঁর রাস্তা তৈরি হয় গণ-ভীতিকে দৃঢ় নেতৃত্বে রূপান্তরের মাধ্যমে।

বিশ্ব মঞ্চে একাকীত্বের সূচনা

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম বড় পরীক্ষা আসে ২০০০ সালে কুর্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয়ে। সরকারের ধীর প্রতিক্রিয়া প্রাথমিকভাবে দুর্বলতা প্রকাশ করলেও, পুতিন দ্রুত শিখে নেন কীভাবে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই ঘটনা তাঁকে অভ্যন্তরীণভাবে আরও সাবধানী করে তোলে।

কিন্তু আসল সংঘাত শুরু হয় আন্তর্জাতিক মঞ্চে। প্রাক্তন ইস্টার্ন ব্লক দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ন্যাটোর ক্রমাগত সম্প্রসারণকে পুতিন রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রতি 'অস্তিত্বের হুমকি' হিসেবে দেখেন। ২০০৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে তাঁর দেওয়া ভাষণ ছিল পশ্চিমা অহংকার ও কপটতার বিরুদ্ধে এক সুস্পষ্ট চ্যালেঞ্জ। তিনি একটি বহু-মেরু বিশ্ব ব্যবস্থার পক্ষে ওকালতি করেন, যেখানে রাশিয়ারও সমান ক্ষমতা থাকবে।

ক্ষমতা সুসংহতকরণ এবং জর্জিয়া আক্রমণ

সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা এড়াতে পুতিন এক কৌশল সাজান তিনি তাঁর অনুগত প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের সাথে ভূমিকা বদল করেন, পরে ২০১২ সালে আবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে ফিরে আসেন। এর মাধ্যমে তিনি তার ক্ষমতাকে কার্যত আজীবনের জন্য সুসংহত করেন।

২০০৮ সালে যখন ন্যাটো ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে সদস্যতার সম্ভাবনা দেখায়, তখন পুতিন এটিকে সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখেন এবং এর ফলস্বরূপ রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে। এটি ছিল তাঁর ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতির প্রথম স্পষ্ট প্রকাশ। অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতের উপর কঠোর দমন অভিযানের মাধ্যমে তিনি সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধিতাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন, নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলে।

ইউক্রেন ও ওয়াগনার বিদ্রোহ

পশ্চিমা প্রভাব মোকাবেলার লক্ষ্যে, পুতিন ২০১২ সালের পর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সাথে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত জোট গঠন করেন। কিন্তু তাঁর মনোযোগ ক্রমশ ইউক্রেনের দিকে নিবদ্ধ হয়, যাকে তিনি রাশিয়ার ঐতিহাসিক অঞ্চলের অংশ এবং পশ্চিমের প্রভাব থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য স্থির করেন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ এবং ডনবাস সংঘাতের পর, ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ ছিল তাঁর এই লক্ষ্যের চূড়ান্ত পদক্ষেপ।

ironically , এই আগ্রাসন ন্যাটো জোটকে আরও শক্তিশালী এবং সম্প্রসারিত করেছে, যা পুতিনের প্রাথমিক উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে। সম্প্রতি ২০২৩ সালে ওয়াগনার গোষ্ঠীর বিদ্রোহ ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় প্রথম গুরুতর অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। যদিও এই বিদ্রোহ দ্রুত শেষ হয়, তবে এটি রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা প্রকাশ করে।

কেজিবি-র একজন গোয়েন্দা থেকে শুরু করে বিশ্বের এক প্রভাবশালী ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান—ভ্লাদিমির পুতিনের এই যাত্রা নাটকীয় কৌশল, কঠোরতা এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের মিশেলে তৈরি। তাঁর উত্তরাধিকার কী হবে, তা নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলো তিনি কীভাবে মোকাবিলা করেন তার ওপর। 

সূত্র, বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম